০১:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

“যাদের কথা রাষ্ট্র খুব একটা মনে রাখেনি”

  • Khalid Hasan Ripu
  • আপডেট : ০৫:৪৮:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২
  • ৭২ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিদিনের পোস্ট || যাদের কথা রাষ্ট্র খুব একটা মনে রাখেনি|

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্মান্তরিত করার পেছনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অপরাধে লিপ্ত ছিল শান্তি কমিটি, আলশামস, আলবদর, ইসলামী ছাত্র সংঘ, জামায়াতে ইসলামীর মতন দলগুলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি সংবিধানে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দেন। এর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়, তবে দুঃখের বিষয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এর অপব্যবহার শুরু করে।

আমাদের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের দিকে ফিরে তাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার মতন মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষকে বেছে বেছে হত্যা, তাদের ঘরের স্ত্রী-কন্যা বা বোনকে ধর্ষণ করা, তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার ঘটনা অগণিত। আজ দুজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা বলতে চাই। তাদের একজন সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী, আরেকজন শিক্ষক এবং ধর্ম ছিল হিন্দু। ঢাকার বাইরে এমন শত শত শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম খুঁজলে পাওয়া যাবে, যাদের কথা রাষ্ট্র খুব একটা মনে রাখেনি।

শহীদ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী প্যারী মোহন আদিত্য। ১৯৩৪ সালের ৫ জুন সাবেক টাঙ্গাইল মহকুমার বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোকন্দ মোহন আদিত্য, মা মহামায়া আদিত্য। চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য ছিলেন দ্বিতীয়। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র পুরুষোত্তম প্রথাগত শিক্ষা ও আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার কুফল সম্পর্কে সদাসচেতন ছিলেন। তিনি জীবনমুখী বাস্তববিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যার একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের অন্যতম শিষ্য প্যারী মোহন আদিত্য। তিনি তার বাবাকে সহযোগিতায় কাজের পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা, গান, নাটক, আবৃত্তি, সমাজসেবা, যাত্রাপালা ও পত্রিকা সম্পাদনায় অধিক মনোযোগী ছিলেন। ১৯৫৮ সালে প্যারী মোহন আদিত্য ভারতের বিহার প্রদেশের দেওঘর থেকে অনুকুল চন্দ্রের মহামূল্যবান পাদুকা এনে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে স্থাপন করেন। ‘সৎসঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। অল্পদিনেই প্যারী মোহন আদিত্য এলাকার সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়ে ওঠেন।

পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের ওপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কয়েকবার ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালিত হয়। সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে পরপর শেল আঘাত করে মন্দিরের শীর্ষ চূড়া গুঁড়িয়ে দেয়। অল্পের জন্য প্যারী মোহন আদিত্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পরিবারসহ বেঁচে যান। আবার সেবাধর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক মাস পরই ১৯৭১ সালের ২১ মে আবার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরা অতর্কিত হামলা চালায় পাকুটিয়া বাজার ও পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। গ্রেপ্তার হন প্যারী মোহন আদিত্য। তাকে থানা সদর ঘাটাইল ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। অবর্ণনীয় নির্যাতন চলে তার ওপর। কোনো একভাবে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।

অবশেষে আসে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের জীবনে ভয়াবহ কালোদিন। ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সৎসঙ্গ আশ্রম আবার আক্রান্ত হয়। মুহুর্মুহু গুলি চলতে থাকে। প্যারী মোহন আদিত্য পালানোর সুযোগও পান না। পাকিস্তানি বাহিনী তার তলপেটে গুলি চালায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চালানো হয় বেয়নেট ও ছুরিকাঘাত। সে অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জিজ্ঞেস করতে থাকে নরপশুর দল।

দেশপ্রেমিক প্যারী মোহন আদিত্য নির্বাক থেকে নির্যাতিত হতে হতে দেশের তরে জীবন উৎসর্গ করেন। পরে বড় ভাই সৎসঙ্গ সম্পাদক রাসবিহারী আদিত্য ও পরিবারের লোকজন গোপনে বাড়ির পাশে তার বাবা ও মায়ের সমাধির পাশে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। শহীদ জায়া বীণা রানী আদিত্য স্বামী শোকে কোথায় যেন হারিয়ে যান, তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাদের একমাত্র সন্তান নটো কিশোর আদিত্য তখন মাত্র ছয় মাস বয়স। পরে জ্যাঠা এবং দাদুর কাছে বড় হয়েছেন।

শহীদ অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়। ১৯৪১ সালের ১০ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার কামেল্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি ছিলেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সেই কলেজের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন।

১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে এবং এলাকার তরুণদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংগঠিত করতে অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় নিজ বাসায় একটি বৈঠক করেন। সে এলাকার সংখ্যালঘুদের ওপর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলাম নজরদারিতে রাখত। সেদিন সেই বৈঠকের খবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতে দেরি করেনি সেই রাজাকার। ঠিক রাত নয়টায় অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের বাড়িটি ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। বুটের লাথিতে দরজা ভেঙে এক এক করে অধ্যাপক সুনীলবরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে রাইফেলের বাঁট দিতে নির্মমভাবে পেটাতে পেটাতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে।

কালাচাঁদ রায়ের স্ত্রী নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী রায় প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেও নির্মম অত্যাচার করা হয়। এর পর ধরে আনা হয় রসায়নের আরেক অধ্যাপক আবদুর রহমান এবং উর্দু সাহিত্যের অধ্যাপক শাহ মো. সোলায়মানকে। ওনাদের সবাইকে বেধড়ক পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তোলা হয়। এর পর ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে মিলিটারি কনভয় রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের দমদমা ব্রিজে গিয়ে থামে। রাস্তার পাশে একটি বাঁশঝাড়ের সামনে তাদের পিছমোড়া করে বেঁধে সারিবদ্ধ দাঁড় করায় ওরা। কেউ কিছু বোঝার আগেই হানাদার বাহিনীর রাইফেল থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে হেফাজতের তাণ্ডব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ ৫১ বছরে স্বাধীনতার পূর্তি হবে। মনেপ্রাণে এখনো সেই একই দাবি নিয়ে আগামীর দিনগুলোতে চলতে চাই- ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি এই স্বাধীন ভূখন্ডে ধর্মনিরপেক্ষতার বলয়ে ফিরে যেতে চাই।

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ । রিপু /প্রতিদিনের পোস্ট

Facebook Comments Box
সম্পাদনাকারীর তথ্য

Khalid Hasan Ripu

error: Content is protected !!

“যাদের কথা রাষ্ট্র খুব একটা মনে রাখেনি”

আপডেট : ০৫:৪৮:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিদিনের পোস্ট || যাদের কথা রাষ্ট্র খুব একটা মনে রাখেনি|

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্মান্তরিত করার পেছনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অপরাধে লিপ্ত ছিল শান্তি কমিটি, আলশামস, আলবদর, ইসলামী ছাত্র সংঘ, জামায়াতে ইসলামীর মতন দলগুলো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি সংবিধানে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দেন। এর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়, তবে দুঃখের বিষয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে কাজে লাগিয়ে এর অপব্যবহার শুরু করে।

আমাদের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের দিকে ফিরে তাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যার মতন মুসলিম ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষকে বেছে বেছে হত্যা, তাদের ঘরের স্ত্রী-কন্যা বা বোনকে ধর্ষণ করা, তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করার ঘটনা অগণিত। আজ দুজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা বলতে চাই। তাদের একজন সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী, আরেকজন শিক্ষক এবং ধর্ম ছিল হিন্দু। ঢাকার বাইরে এমন শত শত শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম খুঁজলে পাওয়া যাবে, যাদের কথা রাষ্ট্র খুব একটা মনে রাখেনি।

শহীদ সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী প্যারী মোহন আদিত্য। ১৯৩৪ সালের ৫ জুন সাবেক টাঙ্গাইল মহকুমার বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোকন্দ মোহন আদিত্য, মা মহামায়া আদিত্য। চার ভাইয়ের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য ছিলেন দ্বিতীয়। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র পুরুষোত্তম প্রথাগত শিক্ষা ও আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার কুফল সম্পর্কে সদাসচেতন ছিলেন। তিনি জীবনমুখী বাস্তববিদ্যা ও অধ্যাত্মবিদ্যার একজন একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের অন্যতম শিষ্য প্যারী মোহন আদিত্য। তিনি তার বাবাকে সহযোগিতায় কাজের পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চা, গান, নাটক, আবৃত্তি, সমাজসেবা, যাত্রাপালা ও পত্রিকা সম্পাদনায় অধিক মনোযোগী ছিলেন। ১৯৫৮ সালে প্যারী মোহন আদিত্য ভারতের বিহার প্রদেশের দেওঘর থেকে অনুকুল চন্দ্রের মহামূল্যবান পাদুকা এনে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে স্থাপন করেন। ‘সৎসঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকেন। পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। অল্পদিনেই প্যারী মোহন আদিত্য এলাকার সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়ে ওঠেন।

পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের ওপর মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কয়েকবার ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালিত হয়। সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে পরপর শেল আঘাত করে মন্দিরের শীর্ষ চূড়া গুঁড়িয়ে দেয়। অল্পের জন্য প্যারী মোহন আদিত্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পরিবারসহ বেঁচে যান। আবার সেবাধর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক মাস পরই ১৯৭১ সালের ২১ মে আবার পাকিস্তানি ও তাদের দোসরা অতর্কিত হামলা চালায় পাকুটিয়া বাজার ও পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। গ্রেপ্তার হন প্যারী মোহন আদিত্য। তাকে থানা সদর ঘাটাইল ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। অবর্ণনীয় নির্যাতন চলে তার ওপর। কোনো একভাবে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।

অবশেষে আসে পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমের জীবনে ভয়াবহ কালোদিন। ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সৎসঙ্গ আশ্রম আবার আক্রান্ত হয়। মুহুর্মুহু গুলি চলতে থাকে। প্যারী মোহন আদিত্য পালানোর সুযোগও পান না। পাকিস্তানি বাহিনী তার তলপেটে গুলি চালায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। চালানো হয় বেয়নেট ও ছুরিকাঘাত। সে অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জিজ্ঞেস করতে থাকে নরপশুর দল।

দেশপ্রেমিক প্যারী মোহন আদিত্য নির্বাক থেকে নির্যাতিত হতে হতে দেশের তরে জীবন উৎসর্গ করেন। পরে বড় ভাই সৎসঙ্গ সম্পাদক রাসবিহারী আদিত্য ও পরিবারের লোকজন গোপনে বাড়ির পাশে তার বাবা ও মায়ের সমাধির পাশে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। শহীদ জায়া বীণা রানী আদিত্য স্বামী শোকে কোথায় যেন হারিয়ে যান, তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাদের একমাত্র সন্তান নটো কিশোর আদিত্য তখন মাত্র ছয় মাস বয়স। পরে জ্যাঠা এবং দাদুর কাছে বড় হয়েছেন।

শহীদ অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়। ১৯৪১ সালের ১০ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার কামেল্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রসায়নশাস্ত্রে এমএসসি ছিলেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সেই কলেজের রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে ছিলেন।

১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে এবং এলাকার তরুণদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংগঠিত করতে অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় নিজ বাসায় একটি বৈঠক করেন। সে এলাকার সংখ্যালঘুদের ওপর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলাম নজরদারিতে রাখত। সেদিন সেই বৈঠকের খবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতে দেরি করেনি সেই রাজাকার। ঠিক রাত নয়টায় অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের বাড়িটি ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনী। বুটের লাথিতে দরজা ভেঙে এক এক করে অধ্যাপক সুনীলবরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে রাইফেলের বাঁট দিতে নির্মমভাবে পেটাতে পেটাতে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে।

কালাচাঁদ রায়ের স্ত্রী নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী রায় প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেও নির্মম অত্যাচার করা হয়। এর পর ধরে আনা হয় রসায়নের আরেক অধ্যাপক আবদুর রহমান এবং উর্দু সাহিত্যের অধ্যাপক শাহ মো. সোলায়মানকে। ওনাদের সবাইকে বেধড়ক পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তোলা হয়। এর পর ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে মিলিটারি কনভয় রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের দমদমা ব্রিজে গিয়ে থামে। রাস্তার পাশে একটি বাঁশঝাড়ের সামনে তাদের পিছমোড়া করে বেঁধে সারিবদ্ধ দাঁড় করায় ওরা। কেউ কিছু বোঝার আগেই হানাদার বাহিনীর রাইফেল থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়। ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে হেফাজতের তাণ্ডব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে আজ ৫১ বছরে স্বাধীনতার পূর্তি হবে। মনেপ্রাণে এখনো সেই একই দাবি নিয়ে আগামীর দিনগুলোতে চলতে চাই- ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে আমরা সবাই বাঙালি এই স্বাধীন ভূখন্ডে ধর্মনিরপেক্ষতার বলয়ে ফিরে যেতে চাই।

এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ । রিপু /প্রতিদিনের পোস্ট

Facebook Comments Box